ইতিহাস ঐতিহ্যের চেতনায় সোনারগাঁও একটি প্রাচীন জনপদ, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষা বিধৌত এ জনপদটির অবস্থান ও বয়স কতোদিনের এ বিষয়ে গবেষনার যথেষ্ট দাবী রাখলেও এ কথাটি অস্বীকারের জো নেই যে সোনারগাঁও সভ্যতার বয়স ইতোমধ্যে দেড় সহস্র বছর পেরিয়ে গেছে। উয়ান চুয়াং এর মতো বিশ্বখ্যাত চৈনিক পন্ডিত এবং তিববতীয় ইতিহাস প্যাগ সাম জ্যাং জং এর ধারনানুসারে তৎকালীন সুবর্ণগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় বিধৃত আছে প্রাক সোনারগাঁয়ের ইতিহাসে। সুবর্ণগ্রাম বা আধুনিক সোনরগাঁয়ের ভিত্তী যদিও গড়ে উঠেছে হিন্দুশাহী প্রশাসনিক কেন্দ্র বিক্রমপুরের পতনের পর তারপরেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র স্বাক্ষ্য দেয় যে, প্রাক সুলতানি যুগে সুবর্ণগ্রাম একটি আভ্যন্তরীন আর্ন্তজাতিক নদী বন্দর হিসেবে এর অস্তিত্ব এ উপমহাদেশের পরিধি ছাপিয়েও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপ্ত হয়েছিল। বৈদিক যুগে গ্রীক নাবিক ও ব্যবসায়ীদের যে প্রাচীন নিম্নবঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের তটরেখা বরাবর সমৃদ্ধ নগরীও বানিজ্য বন্দর গুলোতে পদচারনা ছিল তার পরিচয় কিন্তু মিলে অজানা গ্রীক নাবিকদের লেখা ‘‘পেরিপ্লাস’’ গ্রন্থ থেকে। পেরিপ্লাস গ্রন্থের অজানা নাবিকেরা ব্রহ্মপুত্রের তট বেয়ে এ অঞ্চলে যাতায়াত ছিল মূলত এ বদ্বীপের সমৃদ্ধ বস্ত্র শিল্পের জন্য। ঐতিহাসিক ও বিদগ্ধ পন্ডিতদের ধারনা নিম্নবঙ্গের বিশেষ করে সুবর্ণগ্রামের পৃথিবীখ্যাত চারু ও কারু শিল্প জাত দ্রব্যাদির জন্যই এখানে আসা বিচিত্র কিছুই ছিল না গ্রীক নাবিকদের। হিন্দু পুরানের রানী কৈকিয়ির আব্দার ছিল সুবর্ণগ্রামের সুক্ষ্ম বস্ত্রের জন্যে। মিথই বলি আর ইতিহাসই বলি এ সমস্ত ঘটনার সূত্রপাত খৃস্টপুর্বকাল থেকেই । কাজেই একথাটা বলা যায় খৃষ্টপূর্বকালের বদ্ধীপের এই নিম্নভূমি ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করেছিল। আরেকটি সূত্র স্বাক্ষ্য দেয় সুগন্ধিজাত মশলা রপ্তানিতেও সুবর্ণগ্রাম বন্দর নগরীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। চারু ও কারু শিল্প বিকাশের জন্যে যে উর্বর ভূমির প্রয়োজন ছিল তার প্রকৃষ্ট স্বাক্ষী হলো ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পলিবাহিত সমভূমি। প্রাচীন বৌদ্ধ দোহার সুক্ষ্ম কার্পাসিক বস্ত্র যে কার্পাস থেকে উৎপত্তি হতো তাতো বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রাচীন চর্য্যাপদের ভাষায় সোনারগাঁও অঞ্চলের ভূমি বর্তমানে কাপাসিয়া অঞ্চলকেই বুঝাই একথাও স্বীকার্য্য। বর্তমান নিবন্ধে সোনারগাঁও অঞ্চলের কথা যে স্থানকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে প্রাচীনত্বের সীমানায় তার পরিধি বিশাল এলাকা জুড়ে। বর্তমানের সংকুচিত ইতিহাসের সোনারগাঁও, সোনারগাঁও উপজেলা কেন্দ্রিক বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পরেছে। প্রাচীনত্বের বিশাল সোনারগাঁয়ের লুপ্ত চারু-কলা লোকশিল্পের বিস্তারিত বিবরন উদঘটন করা সময় সাপেক্ষ এবং সুচিন্তিত বাস্ত্তনিষ্ট গবেষনার ব্যাপার। বর্তমান প্রবন্ধে প্রাচীনত্বের সোনারগাঁয়ের বিশালত্বকে বিসর্জন দিয়ে শুধু উপজেলা ভিত্তীক গবেষনা সীমাবদ্ধতার জন্যে নিবন্ধকার ক্ষমাপ্রার্থী।
সোনারগাঁয়ের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা সোনারগাঁও অঞ্চলের লোকশিল্পকে তুলে আনা সময় সাপেক্ষ এবং একটি পূর্নাঙ্গ গবেষনার বিষয়। একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, সোনারগাঁও শুধু প্রশাসনিক গুরুত্ব ও রাজধানী হবার কারনেই বিখ্যাত হয়ে উঠেনি। সোনারগাঁও সুবিখ্যাত হয়েছিল অর্থনৈতিক প্রাচুর্য্য, ভূমি বিন্যাস, কৃষি কৌমজাত উপকরনাদি নির্মাণ ও তার নান্দনিক চারু ও কারু শিল্পের জন্যেই। সোনারগাঁয়ের প্রাচুর্য্য ও সমৃদ্ধতার উৎস ছিল তার নিজস্ব উর্বর ভূমি ও এলাকার দক্ষ চারু-কারু শিল্পীদের উৎপাদিত শিল্পকর্মের জন্যে। পরবর্তীকালে সোনারগাঁয়ের এ সমৃদ্ধ ধারাকে আত্মস্থ ও ধাতস্ত করে ঢাকার সমৃদ্ধ চারু ও কারু শিল্প গড়ে উঠে। এর পশ্চাৎভূমি ছিল সোনারগাঁ অঞ্চলের বিখ্যাত লোকশিল্প। এ লোকশিল্পের ক্ষীয়মান ধারার উত্তরসূরী আমরাই। আমরা এর ধারাবাহিকতার সাথে একাত্ম হতে না পারলেও স্মরণাতীত কালের সোনারগাঁয়ের লোক ও কারুশিল্প হাজার বছর ধরে আমাদের অনুপ্রেরনা যোগাবে। প্রত্যাশা রইল সোনারগাঁয়ের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সোনারগাঁয়ের লোক ও কারুশিল্প গবেষনায় এগিয়ে আসবে। গবেষনা হলে তথ্যাদি প্রকাশ পেলে সোনারগাঁয়ের লুপ্ত ইতিহাস আরো বর্নাঢ্য হবে। মঙ্গল আলোকে উদ্ভাসিত হবে লোক ও কারু শিল্পের চিরায়ত নান্দনিকতার ইতিহাস।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS